অতিরিক্ত হাত-পা ঘামা ও এর মুক্তিতে Iontophoresis চিকিৎসা যেভাবে এলো
বৈদ্যুতিক থেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা সেবার ইতিহাস আধুনিক বিদ্যুৎ আবিষ্কার এর সময়কাল থেকেও অনেক পুরনো। প্রাচীন গ্রীস, রোম ও মিশর এর চিকিৎসকরা বৈদ্যুতিক-থেরাপির সাহায্যে মাইগ্রেন, মৃগী রোগের মত রোগগুলোর চিকিৎসা সেবা দিতেন। সেসব বৈদ্যুতিক থেরাপিতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ এর উৎস ছিল ‘ব্ল্যাক টরপিড’ এর মত বৈদ্যুতিক মাছ। এই মাছ থেকে নি:সৃত বৈদ্যুতিক রশ্মি মাইগ্রেন এর ব্যথা কমাতে সাহায্য করত। পরবর্তীতে গ্রিকরা বৈদ্যুতিক -থেরাপির এতটাই প্রেমে পরে যায় যে তারা বৈদ্যুতিক মাছগুলোর নাম রাখে ‘নারকা’, বাংলায় যার মানে দাঁড়ায়- ব্যথা থেকে মুক্তি। ইংরেজি শব্দ ‘নারকোটিক’ এর উৎপত্তিও এই গ্রিক শব্দ ‘নারকা’ থেকে।
পরবর্তীতে বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন বাসা বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হওয়ারও বেশ আগে নিজের ওপর অন্তত দু’বার বৈদ্যুতিক-থেরাপি ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৭৪৭ সালে ইটালিয়ান লাইব্রেরিয়ান জোভানি ফ্রানসিসকো এক পরীক্ষায় দেখতে পান যে কাঁচের সিলিন্ডারে আবদ্ধ করে রাখা ‘পেরুভিয়ান বলসাম’ নামে এক ধরণের গাছের পাতার উপর বিদ্যুৎ প্রবাহিত করার পর পাতার গন্ধ পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরীক্ষা থেকে প্রথম বোঝা যায় যে গন্ধের রাসায়নিক উপাদান বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮০০ সালে আলেসান্ড্রো ভোল্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহের সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে রাসায়নিক উপাদান মেমব্রেন এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করার জন্য নানাজন নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন ফ্রেঞ্চ চিকিৎসক রেইমেন্ড বার্নাড ফেব্রি-পেলাফা ও পার্শ্ববর্তী দেশ ইংল্যান্ডের বেঞ্জামিন ওয়ার্ড রিচার্ডসন। ইতিহাসের সেই সময়ে তাঁরা অবশ্য “ভোল্টিক নারকোটিজম” নামেই ডেকেছেন এই পদ্ধতিকে। তাঁরা একে মানুষের মুখে লোকাল অ্যানেসথেশিয়া দেয়ার কাজে ব্যবহার করেছিলেন।বেঞ্জামিন ওয়ার্ড রিচার্ডসনকে এর জন্য ডেন্টাল আয়ন্টোফোরেসিসের (Iontophoresis) জনক বলা হয়।
১৮৭০ এর দশকে বেঞ্জামিন ওয়ার্ড রিচার্ডসন এর সমসাময়িক জার্মান দেশের ফিজিওলজিস্ট হেরমান মঙ্ক বৈদ্যুতিক কারেন্ট এর সাহায্যে ছিদ্রযুক্ত মেমব্রেন দিয়ে রাসায়নিক উপাদান পাঠানো যায় কিনা ব্যাপারটা নিয়ে জোরেসোরে কাজ করে যেতে থাকেন। এটাই সম্ভবত ইতিহাসের পাতায় উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে রাসায়নিক উপাদান পাঠানোর প্রথম প্রস্তাব। এর পর উনিশ শতকে আয়ন্টোফোরেসিস (Iontophoresis) পদ্ধতির উন্নয়ন বেশ দ্রুত গতিতে হয়েছে। এই শতকে বিজ্ঞানীরা অবশ্য এর নাম রেখেছিল ক্যাটাফোরেসিস (cataphoresis)। ফ্রিজ ফ্রাঙ্কেনহাউজার বিশ শতকের শুরুর দিকে আয়ন্টোফোরেসিস (Iontophoresis) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি তখন ধাতব আয়নকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করছিলেন। বিশ শতকের প্রায় সব গবেষক মানুষের দেহে ইনজেকশন ছাড়া বৈদ্যুতিক প্রবাহ দিয়ে কিভাবে ওষুধ(রাসায়নিক উপাদান) পাঠানো যায় তার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের কেউই খুব বেশি সফল হতে পারেননি। তবে আকারে ছোট কিছু কিছু রাসায়নিক উপাদানকে বৈদ্যুতিক প্রবাহের মাধ্যমে শরীরে সফলভাবে প্রবেশ করাতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন।
বিশ শতকের মাঝামাঝি আয়ন্টোফোরেসিস (Iontophoresis) এর সফল প্রয়োগ হয় হাইপারহাইড্রোসিস (hyperhydrosis) এর ক্ষেত্রে। হাইপারহাইড্রোসিস (hyperhydrosis) বলতে আমরা হাত,পা,মুখ ও শরীরের অন্যান্য অংশে অতিরিক্ত ঘাম হওয়াকে বুঝি। মৃদু থেকে শুরু করে ফোঁটা-ফোঁটা পানির মত ঘাম পড়তে পারে এ সমস্যায়। অতিরিক্ত ঘাম কেন হয় তার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে কারণগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পুরোপুরি জানা নেই বিজ্ঞানীদের। তাই সমস্যাটির বৈজ্ঞানিক নাম Idiopathic Hyperhidrosis (ইডিওপ্যাথিক হাইপারহাইড্রোসিস) বা অতিরিক্ত ঘামা যার কারণ এখনো অজ্ঞাত।
অতিরিক্ত ঘাম কমানোর উপায় হিসেবে Iontophoresis বর্তমানে একটি বহুল জনপ্রিয় ও কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে হাতের বা পায়ের তালুর ভিতর দিয়ে মৃদু বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিচালিত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি হাত বা পায়ে বিশ মিনিট করে সর্বমোট চল্লিশ মিনিট দৈনিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। টানা দশ থেকে পনেরোদিন (ব্যক্তিভেদে এই সময়কাল কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে) চিকিৎসা নিলে পরবর্তী ৫/৬ সপ্তাহের জন্য অতিরিক্ত ঘাম লক্ষ্যনীয়ভাবে কমে যায়। এই সময়কালের পর হাত পা পুনরায় ঘামা শুরু হলে আবার তিন থেকে চারদিন চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হয়। ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ পর পর এভাবে তিন থেকে চারদিন চিকিৎসা নিলে অতিরিক্ত হাত-পা ঘামা থেকে নিয়মিতভাবে মুক্ত থাকা সম্ভব। অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে এটি সারা বিশ্বেই এখন সমাদৃত।
Iontophoresis পদ্ধতি অতিরিক্ত ঘাম কমাতে কীভাবে সাহায্য করে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। তবে আমাদের শরীরের বায়ো ফিডব্যাক মেকানিজম দিয়ে অনেকে এর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ধারণা করা হয় যে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় বিশেষ কিছু আয়ন ত্বকের ভিতর দিয়ে চলাচল করার সময় ঘর্মগ্রন্থির মুখে হাইপারকেরাটোটিক প্লাগ তৈরি হয় যা মস্তিষ্ককে আর বেশি ঘাম তৈরি না করার সংকেত পাঠায়।
বাংলাদেশে আয়ন্টোফোরেসিস (Iontophoresis) পদ্ধতি প্রয়োগের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে আমরা খুঁজে পাই একই শহরের দু’জন মানুষের কথা, যাদের একজন হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ সিদ্দিক-ই-রব্বানী এবং অন্যজন হলেন বারডেম এর চর্ম চিকিৎসক ডঃ রেজা বিন জায়েদ। ১৯৯২ সালে ড: রেজার অনুরোধে ড: রব্বানী হাইপারহাইড্রোসিস (hyperhydrosis) এর চিকিৎসা করার জন্য এন্টি সোয়েট (Anti-Sweat) নামে একটি অতিরিক্ত ঘাম প্রতিরোধক যন্ত্র তৈরি করেন। ড. রব্বানী ১৯৯৪ সাল থেকে রোগীদেরকে এই যন্ত্র ব্যবহার করে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেন। গত পঁচিশ বছর ধরে Anti-Sweat যন্ত্রটি এদেশের শত শত রোগী ব্যবহার করে আসছেন।
এইসব উদ্যমী মানুষগুলোর প্রচেষ্টায় বৈদ্যুতিক থেরাপির গবেষণা কালের বিবর্তনে উন্নত হয়ে আরও নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে যার প্রয়োগ চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই পৃথিবীর কল্যাণে।